রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫ - ০৮:৩৭
কুরআন ও হাদীসের আলোকে ‘رجعت (পুনরাগমন)’

ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর যুহুরের যুগে কিছু নির্দিষ্ট মৃত ব্যক্তি পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে আসবেন—এই বিশ্বাসকে ইসলামী পরিভাষায় رجعت বলা হয়। এটি শুধুমাত্র শিয়া বিশ্বাস নয়, বরং কুরআন ও নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহে এর স্বতন্ত্র ভিত্তি রয়েছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আলোচ্য নিবন্ধে কুরআনের আয়াত এবং আহলে বাইত (আ.)-এর বর্ণনার আলোকে رجعت-এর প্রমাণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে:

কুরআনে رجعت-এর ইঙ্গিত

হযরত উযায়র (আ.)-এর ঘটনা: হযরত উযায়র (আ.) একশ বছর মৃত থাকার পর আল্লাহর আদেশে পুনরুজ্জীবিত হন এবং বহু বছর জীবনযাপন করেন।

আল্লাহ বলেন,

أَوْ کَالَّذِی مَرَّ عَلَیٰ قَرْیَةٍ وَهِیَ خَاوِیَةٌ عَلَیٰ عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّی یُحْیِی هَٰذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِائَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ کَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ یَوْمًا أَوْ بَعْضَ یَوْمٍ قَالَ بَلْ لَبِثْتَ مِائَةَ عَامٍ فَانْظُرْ إِلَیٰ طَعَامِکَ وَشَرَابِکَ لَمْ یَتَسَنَّهْ وَانْظُرْ إِلَیٰ حِمَارِکَ وَلِنَجْعَلَکَ آیَةً لِلنَّاسِ وَانْظُرْ إِلَی الْعِظَامِ کَیْفَ نُنْشِزُهَا ثُمَّ نَکْسُوهَا لَحْمًا ۚ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَیٰ کُلِّ شَیْءٍ قَدِیرٌ.

অথবা তুমি কি তাকে দেখোনি, যে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল?

এ জনপদের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে ছিল—ছাদগুলো দেয়ালের উপর ধসে পড়েছিল এবং বাসিন্দাদের মৃতদেহ ও অস্থিসমূহ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

সে মনে মনে বলল, “আল্লাহ কিভাবে এদেরকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করবেন?”

এ সময় আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত রাখলেন, তারপর তাঁকে জীবিত করে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কতক্ষণ ছিলে?”

সে বলল, “একদিন, বা এক দিনের কিছু অংশ।”

আল্লাহ বললেন, “না, তুমি একশ বছর অবস্থান করেছিলে। এখন তোমার খাবার ও পানীয়ের দিকে তাকাও—তাতে এত দীর্ঘ সময়েও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। (এই খাদ্য-দ্রব্যগুলোকে শত বছর ধরে অবিকৃত রাখা আল্লাহর অসীম কুদরতের নিদর্শন।)

আর এখন তোমার গাধার দিকে তাকাও—যেটি সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। আমরা তোমাকে পুনর্জীবিত করেছি যেন তোমাকে মানুষের জন্য এক নিদর্শন বানাই। এখন লক্ষ্য কর—আমি কিভাবে অস্থিগুলোকে সংগ্রহ করি, সেগুলোকে জোড়া লাগাই এবং তার ওপর মাংস পরিয়ে দেই।”

যখন তার সামনে এই বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠল, তখন সে বলল, “আমি এখন জানি, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” [সূরা বাকারাহ, আয়াত ২৫৯]

এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ ইচ্ছা করলে কাউকে মৃত্যুর বহু পরেও দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম।

বানী ইসরাইলের নির্বাচিত ব্যক্তিরা
হযরত মূসা (আ.)-এর সঙ্গী সত্তরজন নির্বাচিত ব্যক্তি তূর পাহাড়ে আল্লাহর সংলাপ প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে অহেতুক দাবি করেন: “আমরা আল্লাহকে স্পষ্টভাবে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করব না।”

এই দাবি’র কারণে তারা বজ্রাঘাতে মারা যান। পরে হযরত মূসা (আ.)-এর দোয়ায় আল্লাহ তাদের পুনরুজ্জীবিত করেন।
আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ بَعَثْنَاکُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِکُمْ لَعَلَّکُمْ تَشْکُرُونَ
তারপর আমরা তোমাদের মৃত্যুর পর জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। [সূরা বাকারাহ, আয়াত ৫৬]

ভবিষ্যতে পুনরাগমন
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন,
وَیَوْمَ نَحْشُرُ مِنْ کُلِّ أُمَّةٍ فَوْجًا مِمَّنْ یُکَذِّبُ بِآیَاتِنَا فَهُمْ یُوزَعُونَ.
স্মরণ কর, যেদিন আমরা প্রতিটি জাতি থেকে একদল লোককে একত্র করব যারা আমার আয়াতকে অস্বীকার করত... [সূরা নামল, আয়াত ৮৩]

এই আয়াতে কিয়ামতের সাধারণ উত্থান নয়, বরং বিশেষ একটি দিনের কথা বলা হয়েছে— যেখানে কেবল নির্দিষ্ট কিছু লোককে জীবিত করা হবে। কেননা কিয়ামতের দিন তো সবাইকে একসঙ্গে উঠানো হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَیَوْمَ نُسَیِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَی الْأَرْضَ بَارِزَةً وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا.
...আমরা তাদের সবাইকে একত্র করব, এবং তাদের কাউকে ফেলে রাখা হবে না। [সূরা কাহাফ, আয়াত ৪৭]

রাজআত (رجعت)-এর রেওয়ায়াত ও তাফসির
তাফসিরে মাজমা‘উল বায়ান-এ প্রখ্যাত শিয়া মুফাসসির মরহুম তাবারসি (রহ.) উল্লেখ করেছেন যে, আহলে বাইত (আ.)-এর বহু নির্ভরযোগ্য হাদীসের আলোকে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর যুহুরের যুগে কিছু ঈমানদার এবং কিছু জালিম ও শত্রুপক্ষের মানুষ দুনিয়ায় ফিরে আসবেন। এই পুনরাগমন বা رجعت–এর উদ্দেশ্য হলো সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত বিভাজন এবং আল্লাহর বিচার ব্যবস্থার প্রকাশ।

আরও একটি কুরআনিক ইঙ্গিত
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,
وَحَرَامٌ عَلَیٰ قَرْیَةٍ أَهْلَکْنَاهَا أَنَّهُمْ لَا یَرْجِعُونَ
“যে জনপদসমূহকে আমি ধ্বংস করেছি, তাদের জন্য (পুনরায়) ফিরে আসা হারাম করে দেওয়া হয়েছে।” [সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৯৫]

এই আয়াতটি رجعت-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। কেননা, কিয়ামতের দিন তো সব মানুষ—মু’মিন, কাফের, জালিম, মজলুম—সবারই পুনরুত্থান হবে। সে হিসেবে, "তারা আর ফিরবে না" — এ বক্তব্য কিয়ামতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। ফলে মুফাসসিরগণ বলেছেন, এখানে ‘ফিরে আসবে না’ বলতে বোঝানো হয়েছে দুনিয়ায় ফিরে আসা, যা رجعت-এর বিষয়।

আহলে বাইত (আ.)-এর ব্যাখ্যা: ইমাম বাকির (আ.) ও ইমাম সাদিক (আ.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেন,
فهذه الآیة من أعظم الدلالة فی الرجعة، لان أحدا من أهل الاسلام لا ینکر أن الناس کلهم یرجعون إلی القیامة، من هلک ومن لم یهلک، فقوله: «لا یرجعون» عنی فی الرجعة، فأما إلی القیامة یرجعون حتی یدخلوا النار.
“এই আয়াতটি رجعت-এর সবচেয়ে বড় প্রমাণগুলোর মধ্যে একটি। কারণ ইসলাম ধর্মে কেউ অস্বীকার করে না যে কিয়ামতের দিন সব মানুষ—যারা ধ্বংস হয়েছে বা হয়নি—সকলেই ফিরে আসবে। সুতরাং আল্লাহর বাণী ‘তারা আর ফিরবে না’ (لَا یَرْجِعُونَ) এখানে কিয়ামতের জন্য নয়, বরং দুনিয়ায় ফেরার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। আর কিয়ামতের দিন তারা অবশ্যই ফিরে আসবে—অন্তত জাহান্নামে প্রবেশ করার জন্য হলেও।”

এই আয়াত থেকে একটি মৌলিক বিষয় বোঝা যায়: কিয়ামতের পুনরুত্থান (بعث) সার্বজনীন ও অবধারিত। কিন্তু رجعت একটি নির্বাচিত, সীমিত ও দুনিয়াকেন্দ্রিক পুনরাগমন, যা বিশেষ আল্লাহর ইচ্ছায় নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত।

এখানে ‘ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা (হারাম)’ বলতে বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলেছে এবং তাদের জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছে, তাদের দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনা হবে না। কারণ رجعت শুধু ঈমানদার ও শত্রুপক্ষের প্রতিনিধিদের জন্য হবে—যাদের দ্বারা সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব স্পষ্টতর হবে।

উল্লেখিত আয়াত ও রেওয়ায়াতসমূহ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে رجعت একটি কল্পনাপ্রসূত ধারণা নয় বরং একটি বাস্তব ধর্মীয় সত্য, যা ইমাম মাহদী (আ.)-এর যুহুরের যুগে সংঘটিত হবে। এই পুনরাগমন একদিকে যেমন আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ, তেমনই সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত বিচার এবং ইমানদার ও অস্বীকারকারীদের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করবে।

গ্রন্থসূত্র: নেগীনে অফারিনেশ গ্রন্থ থেকে সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত রূপে সংকলিত।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha